বায়তুশ শরফ আনজুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ
বায়তুশ শরফ আনজুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ
বায়তুশ শরফ মানে সম্মানের ঘর। বায়তুশ শরফ মসজিদ কেন্দ্রিক এটি একটি ধর্মীয় আধ্যাত্মিক প্রতিষ্ঠান। যার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। বায়তুশ শরফ আনজুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ মসজিদ ভিত্তিক একটি মানব সেবামূলক সংগঠন। মসজিদ আপাত অর্থে যদিও ইবাদতগাহ কিন্তু এ কথা মনে রাখতে হবে যে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর পার্থিব ও নবুয়তের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন মদীনার মসজিদে-নববী থেকে। এ মসজিদকে কেন্দ্র করেই বিশ্বময় ইসলাম ধর্ম বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মহানবী (সা.)-এর পরে খােলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে রাসূল (সা.), তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন এবং পরবর্তীতে যুগে যুগে দেশে দেশে হক্কানী-রব্বানী পীর-আউলিয়া কেরামগণ মানবতার কল্যাণে ইসলামের শান্তিপূর্ণ মিশন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এই উপমহাদেশেও ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় পীর-আউলিয়া ও বুজুর্গানে দ্বীনের অবদান সর্বজন স্বীকৃত।
বায়তুশ শরফের মহান প্রতিষ্ঠাতা কুতুবুল আলম শাহ্ সূফী হযরত মাওলানা মীর মোহাম্মদ আখতর (রহ.) আল্লাহর বান্দাদের ঈমানী-রূহানী উৎকর্ষ সাধন এবং জাগতিক প্রয়ােজনে সাহায্য-সহায়তামূলক কাজ পরিচালনায় একটি নিয়মতান্ত্রিক সংগঠন কায়েমের প্রয়ােজন বিশেষভাবে অনুভব করেন। এ উদ্দেশ্যে ১৯৫২ সনের ২রা অক্টোবর আনজুমনে ইত্তেহাদ নামক সুপ্রসিদ্ধ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। আজকে দেশে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত শত শত মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা, চক্ষু, পঙ্গু ও শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাসহ নানামুখি ঈমানী-রুহানী মাহফিলের আয়ােজন ও সেবামূলক কর্মকাণ্ডসমূহের বাস্তবায়ন সেই মহান আধ্যাত্মিক সাধকের গভীর উপলব্ধির বাস্তব ফসল।
উল্লেখ্য যে, এই অলিকুল শিরােমণি কুতুবুল আলম শাহসূফী আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মীর মুহাম্মদ আখতর- হযরত কেবলা (রহ.) ১৯৭১ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি জীবনের ২৯তম হজ্বব্রত পালনকালে উকুফে আরাফা শেষে পবিত্র মিনার হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। পরদিন মহান রাব্বুল আলামিনের ব্যতিক্রমী অলৌকিক ইচ্ছায় পবিত্র হেরেমে কাবায় এশার নামাজের পর লক্ষ লক্ষ হজ্ব পালনকারীর উপস্থিতিতে তাঁর একক নামাজে জানাজা শেষে তাঁকে পবিত্র ‘জান্নাতুল মোয়াল্লায়’ চিরশায়িত করা হয়।
তিনি ইন্তেকালের পূর্বেই পবিত্র কাবা শরীফের সম্মুখে খিলাফতের দায়িত্বভার তাঁর সুযােগ্য খলিফা হাদীয়ে যামান শাহ সুফী হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার- হুজুর কেবলা (রহ.)-এর উপর অর্পণ করেন। হযরত কেবলা (রহ.)-এর ইন্তেকালের সাথে সাথেই আনজুমনে ইত্তেহাদ-এর সামগ্রিক দায়িত্ব তাঁর উপর বর্তায়। উল্লেখ্য হযরত কেবলা (রহ.) এর জীবদ্দশায় ১৯৬০ সাল হতেই তিনি আনজুমনে ইত্তেহাদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। স্বীয় পীর-মুর্শিদের পদাঙ্ক অনুসারী এই মহান অলি শরীয়ত ও তরিকতের প্রচার ও প্রসারে নিরলসভাবে আত্মনিয়ােগ করেন। মুর্শিদে বরহকের অর্পিত দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন সেবাধর্মী পরিকল্পনা প্রণয়ন, গ্রহণ ও বাস্তবায়ন তথা খেদমতে খাল্কের উদ্দেশ্যে নিজের সামগ্রিক শক্তি-সামর্থ, তথা আপন জীবন উৎসর্গ করে গিয়েছেন। তিনি তরীকায়ে আলীয়ায়ে কাদেরিয়ার মাধ্যমে তজক্বিয়ায়ে নফস ও ছফায়ে কুলুবের জন্য বিভিন্ন মাহফিল ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সমগ্ৰ বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেন। দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠা করেন আনজুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশের শাখা-প্রশাখা। ৬০টি মসজিদ, ১৫টি এতিমখানা, ১০টি মাদরাসা ও হেফজখানা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, দাতব্য চিকিৎসালয়, হাসপাতাল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। তাঁর শিক্ষা আন্দোলনের প্রকৃষ্ট ফসল ‘আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম’ এবং সুদবিহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তনের বাস্তব উদাহরণ বেসরকারি পর্যায়ে দেশের সর্ববৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’। এই ক্ষণজন্মা আল্লাহর অলি সমাজের ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবী, সাধারণ শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিতদের সমন্বয়ে মসজিদ ভিত্তিক মানবসেবামূলক ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে আনজুমনে ইত্তেহদকে লক্ষ কোটি মানুষের অন্তরে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সংগঠন হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের একান্ত আপনজন অকুতোভয় এই মর্দেমুজাহিদ জীবনের ৩৩তম হজ্বব্রত পালনের পরবর্তী বছর ১৯৯৮ সালের ২৫শে মার্চ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে আকস্মিকভাবে ইন্তেকাল করেন। ঐতিহাসিক রেলওয়ে পোলোগ্ৰাউন্ড ময়দানে লক্ষ লক্ষ মুমিন-মুসলমানের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত স্মরণাতীতকালের বৃহত্তম জানাজা শেষে তাঁকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় বায়তুশ শরফ মসজিদের দক্ষিণ পার্শ্বে ও তাঁরই হাতে প্রতিষ্ঠিত বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল (অনার্স-মাস্টার্স) মাদরাসার সম্মুখস্থ ফুল বাগানে সমাহিত করা হয়। এই গৌরব উজ্জ্বল পবিত্র জীবনের অধিকারী শাহ আবদুল জব্বার (রহ) নিজের নামকে বাংলার ইতিহাসে সােনালী অক্ষরে লিখে গিয়েছেন। তাঁর খেলাফতের ২৭ বছরে (১৯৭১- ১৯৯৮ ইং) পরিকল্পিত ও গঠনমূলক কাজ বায়তুশ শরফের শান ও মানকে জগতময় ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। এজন্যই তাঁকে বলা হয় বায়তুশ শরফের প্রধান রূপকার (Chief Architect or Builder of Baitush Sharaf)
তাঁর ইন্তেকালের পর হযরত কেবলা (রহ.) ও হুজুর কেবলা (রহ.)-এর সােহবতে ধন্য তাঁদের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী বাহরুল উলুম শাহ সূফী হযরত মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন ছাহেব (রহ.) এপ্রিল ১৯৯৮ হতে বায়তুশ শরফ আনজুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশের সভাপতির পদে নিয়ােজিত হন। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে বায়তুশ শরফ আনজুমনে ইত্তেহাদ একটি ধর্মীয়, সামাজিক ও তামাদ্দুনিক আন্দোলনে পরিণত হয়। তিনি হুজুর কেবলা (রহ.) এর রেখে যাওয়া কর্মসূচিগুলাে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। তাঁর আমলে (২২ বছরে) সারা দেশে নতুন নতুন আরও অনেক মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা ও হেফজখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনিও শিক্ষা ও সমাজ কল্যাণমূলক কার্যক্রম, দুঃস্থ-মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে পরিণত বয়সে ২০শে মে ২০২০ ইং, পবিত্র শবে ক্বদরের দিন ইন্তেকাল করেন। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে তাঁর পীর মুর্শিদের পাশেই চিরসমাহিত করা হয়।
বায়তুশ শরফ আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়া একটি আধ্যাত্মিক কেন্দ্র ও ঐতিহ্যবাহী সুবিশাল সংগঠন। বহু বিচিত্র ও সুদূর প্রসারী কর্মকাণ্ডের আকর। ঐতিহাসিকদের মতে, এটি সরকারি বৃত্তের মাঝে পরিচালিত আর একটি সরকার (It’s a Government within Government)। পূর্বোক্ত তিনজন আল্লাহর অলির রেখে যাওয়া এক পবিত্র আমানত এই বায়তুশ শরফ। আল্লাহ মেহেরবান- হুজুরের ইন্তেকালের পর ২৩ মে ২০২০ ইং হতে বায়তুশ শরফের ৪র্থ পীর হিসেবে এ মহান দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন শাহ আবদুল জব্বার (রহ.) এর সুযোগ্য পুত্র, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ, শিক্ষক, গবেষক ও বহুগ্ৰন্থ প্রণেতা আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল হাই নদভী (ম.জি.আ.)। তিনি বায়তুশ শরফ আনজুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশের সভাপতি হিসেবে পূর্ণোদ্যোমে এর বিকাশ-বিস্তৃতি, সুনাম ও সমৃদ্ধিতে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। সুউচ্চ মর্যাদা ও শ্রদ্ধার আসনে আসীন পিতার মত তাঁর নেতৃত্বে এই বায়তুশ শরফ শুধু স্বদেশে নয়, বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়বে এর খ্যাতি, উপকৃত হবে সর্বসাধারণ, এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
বর্তমানে সমগ্র বাংলাদেশে আনজুমনে ইত্তেহাদ-এর কর্মকেন্দ্রসমূহ সক্রিয় রয়েছে। নতুন নতুন শাখা খােলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এছাড়া ইউরোপ, আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশেও এর কর্মকান্ড প্রসার লাভ করেছে।
আনজুমনে ইত্তেহাদ এর পরিচালনাধীন মসজিদসমূহ ‘মসজিদ বায়তুশ শরফ’ নামে পরিচিত। আমাদের মহান হযরত কেবলা (রহ.) ও তাঁর সম্মানিত খলিফাবৃন্দের আন্তরিক প্রচেষ্টায়, দরবারের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ভক্ত-অনুরক্তদের উদার হস্তে দান ও সক্রিয় সহযােগিতায় আল্লাহ পাক সুবহানাহু তা’আলার অশেষ রহমতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ২০০ মসজিদ বায়তুশ শরফ নির্মিত হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি মসজিদ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা হাতে আছে।
বাংলাদেশে ইসলামের প্রবেশদ্বার ও বাণিজ্যিক রাজধানী বন্দর নগরী চট্টগ্রামের ধনিয়ালাপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বায়তুশ শরফ আনজুমনে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ এর প্রধান কার্যালয়। এখান থেকে দেশে বিদেশে শ্রদ্ধেয় পীর ছাহেব হুজুর (ম.জি.আ) এর নির্দেশনায় আনজুমনে ইত্তেহাদের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়।
চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মকেন্দ্র। একটি সুবিশাল মসজিদ, একটি আদর্শ কামিল মাদ্রাসা, একটি এতিমখানা, একটি হেফজখানা, একটি ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান, একটি পত্রিকা অফিস, একটি পাঠাগার, একটি ছাপাখানা, একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র, একটি লাইব্রেরী, একটি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, আনজুমনে ইত্তেহাদ, আনজুমনে নওজোয়ান ও মজলিসুল ওলামা বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং বেকার, অসহায় ও এতিমদের পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সমন্বয়ে এটি গঠিত।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় বায়তুশ শরফের অনুরূপ চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৭৫ কিলােমিটার দূরে লোহাগাড়া উপজেলার আখতারাবাদ (কুমিরাঘােনায়) বায়তুশ শরফের ‘পবিত্র আধ্যাত্মিক অনুশীলন কেন্দ্রে’ একটি মসজিদ, একটি মাদ্রাসা, একটি এতিমখানা, একটি হেফজখানা, একটি হাসপাতাল, মৎস্য চাষ প্রকল্প, বাগান ও সেচ প্রকল্প প্রভৃতি নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ও সমাজ কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
এছাড়া বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, চিরিঙ্গা-চকরিয়া, মহিপাল, ফেনী, ঢাকা ও খুলনা পূর্ণাঙ্গ কর্মকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সুদূর মাঈনীমুখ-লংগদু থানা, রাঙামাটি (পার্বত্য জেলা), মারিশ্যা, বাঘাইছড়ি, খাগড়াছড়ি, সাপলেজা, পিরোজপুর, হাস্লা- নড়াইল, কাহালু-বগুড়া, বটতৈল, কুষ্টিয়া, রেজওয়ান নগর (ভেলুপাড়া), ঈশ্বরদী, সাহাব্দীপুর, গোদাগাড়ী, রাজশাহী, সাভার, ঢাকা, কাঁচপুর, নারায়ণগঞ্জ, ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ কমপ্লেক্স (সুন্দরঘোনা), বাগেরহাটসহ বিভিন্ন স্থানে মসজিদ বায়তুশ শরফ এর কর্মকান্ড এগিয়ে চলেছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে আনজুমনে ইত্তেহাদ প্রাথমিক পর্যায় থেকে উচ্চতর পর্যায়ের শিক্ষা প্রদান এবং গবেষণার কাজ পরিচালনা এবং ইসলামী ব্যাংকিং, বাংলাদেশে ইসলাম ও ইসলামী শরীয়ত, ইতিহাস-ঐতিহ্যের উপর জাতীয় পর্যায়ে বহু সেমিনারের আয়ােজন করছে। এর কর্মপদ্ধতি শুধুমাত্র শিশু-কিশোরদের শিক্ষা প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নিরক্ষর বয়স্তদের আক্ষরিক জ্ঞান ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে উচ্চ শিক্ষিত চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা পরিচালনার সুযােগ এই সংগঠন সৃষ্টি করেছে।
আনজুমনে ইত্তেহাদের এতিমখানাসমূহ প্রকৃত অর্থে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কেন্দ্র। এ সংগঠন ২৬টি এতিমখানা দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচালনা করে থাকে, যাতে প্রায় আড়াই হাজার অসহায় এতিমের লালন-পালনের সুব্যবস্থা রয়েছে। এতিমদেরকে প্রতিষ্ঠানের খরচায় খানা-পিনা, পোশাক-পরিচ্ছদ, থাকার ব্যবস্থা, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ এবং প্রয়ােজনীয় চিকিৎসা দান করা হয়। তাদের পার্থিব ও ধর্মীয় শিক্ষাদান ছাড়াও সেলাই, কাঠের কাজ, প্যাকেজিং, বাজার থলে তৈরি, ছাপাখানার কাজ, বুক বাইডিং, চুল কাটা প্রভৃতিতে যত্ন সহকারে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থকে। এতিমদের মধ্যে যারা মেধাবী তাদের উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থাও করে থাকে। তাছাড়া গরীব মেধাবী ছাত্রদের আনজুমনে ইত্তেহাদের তরফ থেকে বিভিন্ন বৃত্তি ও আর্থিক সাহায্য প্রদান করা হয়, যাতে তারা ভবিষ্যতে আত্মনির্ভরশীল এবং দেশের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। আলহামদুলিল্লাহ, বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল (অনার্স-মাস্টার্স) মাদরাসা ও এতিমখানা থেকে শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত এতিমগণ আজ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করে দেশ ও জাতির খেদমত করে যাচ্ছেন।
আনজুমনে ইত্তেহাদ বেশ কয়েকটি দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র এবং স্বাস্থ্য প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে। গরীব রােগীরা এখানে বিনা পয়সায় ডাক্তারের উপদেশ, ব্যবস্থাপত্র এবং ঔষধপত্র পেয়ে থাকে। এতে এলােপ্যাথিক এবং হোমিওপ্যাথিক উভয় চিকিৎসা দেয়া হয়। ঢাকা বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্সে দারুশ-শেফা হাসপাতাল পরিচালিত হয়ে আসছে এবং কক্সবাজার বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্সে পূর্ণাঙ্গ একটি চক্ষু হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে। আখতরাবাদে (কুমিরাঘােনা) প্রতিষ্ঠিত ‘বায়তুশ শরফ শাহ্ জব্বারীয়া হাসপাতাল’ রােগীদের নিয়মিত চিকিৎসা প্রদানসহ প্রতি বছর বিনামূল্যে খতনা ও চক্ষু শিবিরের আয়োজন করে। খুলনার রূপসাঘাটস্থ মসজিদ বায়তুশ শরফেও একটি দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র পরিচালিত হয়ে আসছে।
আনজুমনে ইত্তেহাদ বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সমাবেশের (মাহফিল) আয়ােজন করে থাকে। এর মধ্যে লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়ার আখতরাবাদে (কুমিরাঘােনায়) বাৎসরিক ঈছালে ছাওয়াব মাহফিল, কক্সবাজার বায়তুশ শরফে ফাতেহায়ে ইয়াজদাহুম উপলক্ষে ঈছালে ছাওয়াব মাহফিল এবং অনৈসলামিক কার্যকলাপ উচ্ছেদের লক্ষ্যে প্রতি বছর বাগেরহাট হযরত খান জাহান আলী (রহ.) এর মাযার ও ঐতিহাসিক ঘাট গম্বুজ মসজিদ প্রাঙ্গণে তিন দিনব্যাপী ঈছালে ছাওয়াব মাহফিল এবং চট্টগ্রামের লােহাগাড়া থানার বড়হাতিয়ায় জবলে সিরাতে অনুষ্ঠিত মাহফিল বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এসব মাহফিলে অসংখ্য আল্লাহর বান্দা ভক্তি শ্রদ্ধা নিয়ে শরীক হন এবং ধর্মীয় শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ করে নিজেদের জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা কৱেন।
আনজুমনে ইত্তেহাদের একটি বিশেষ কর্মসূচি হলাে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম। বিভিন্ন সময়ে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসে দুর্গত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আন্জুমনে ইত্তেহাদের একটি অনন্য ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া আনজুমনের তরফ থেকে সারা বছর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গরীব, অসহায়, দুঃস্থ, এতিম ও নওমুসলিমদের পুনর্বাসন, গৃহ নির্মাণ, দুঃস্থ মেয়েদের বিয়ে, পড়াশােনার খরচ ইত্যাদির জন্যও সাহায্য সহযােগিতা প্রদান করা হয়ে থাকে।
এভাবে আনজুমনের বাস্তবধর্মী কর্মকাণ্ড ও প্রকল্পসমূহ মানুষকে সত্যিকারের মু’মিন হওয়ার সুযােগ করে দিচ্ছে। তাই আনজুমনে ইত্তেহাদ এবং এর কর্মকেন্দ্র মসজিদ বায়তুশ শরফসমূহ বাংলাদেশে ও বহির্বিশ্বে সর্বস্তরের মানুষের ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালােবাসার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
বায়তুশ শরফ আনজুমনে ইত্তেহাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এবং প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পসমূহ পরিচালনায় বহু অর্থের প্রয়ােজন। এতিম শিশুদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ সংস্থা (IIRO), বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (FAO), বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) হতে প্রাপ্ত সাহায্য সহযােগিতা আমরা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করি এবং এজন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানাই। দেশের দানশীল ব্যক্তিদের এককালীন দান, যাকাত, ফিতরা, কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রয়লব্ধ অর্থ এবং আন্জুমনের সদস্য ও ভক্ত-অনুক্তদের মাসিক/এককালীন চাঁদাই এই সংগঠনের নিয়মিত আয়ের প্রধান উৎস।
উল্লেখ্য যে, এই মসজিদ ভিত্তিক মানব কল্যাণ সংগঠনের পক্ষ হতে টাকা পয়সার জন্য কারাে কাছে গিয়ে হাত পাতা হয় না, স্বেচ্ছায় কেউ দান পৌছিয়ে দিলে সাদরে গ্রহণ করা হয়।
মহান আল্লাহ সবার জীবনে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি দান করুন। আমীন।